রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
এইচ,এম হুমায়ুন কবির, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)।।
দেশের সামুদ্রিক জলসীমায় মাছের বংশবিস্তার বাড়াতে আগামী ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মৎস্য সম্পদ মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়েছে, সামুদ্রিক জলসীমায় মাছের বংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই ২০২১ পর্যন্ত মোট ৬৫ দিন পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। নিষেধাজ্ঞার দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে উপকূলের কার্ডধারী ১৮হাজার ৫’শ ৮জন জেলে পরিবারের। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভার নিবন্ধন জেলের ১৮ হাজার ৫’শ ৮জন জেলে। সকল মাঝি ও জেলেরা এখন বেকার সময় পার করছেন। যারা দিন এনে দিন খাওয়া এই সব মানুষের জন্য নেই অন্য কোন পেশার সুযোগ। তবুও যাদের শক্তি সামর্থ আছে তারা মাটি কাটা কিংবা যোগ দিয়েছেন রাজমিস্ত্রির জোগালে হিসেবে আবার কেউ দিন মজুর হিসেবে কাজ করছে। আর যাদের এসব কাজের অভ্যাস নেই তারা মনোযোগী জাল মেরামতের কাজে।
মেরিন ফিশারিজ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছর ৬৫ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ। ২০১৫ সালে এই নিষেধাজ্ঞা চালু হয়। শুরুতে শুধু ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার এর আওতায় থাকলেও ২০১৯ সালে সব ধরনের নৌযানকে এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়। জেলেরা এই সময়ে জীবিকার প্রশ্নে সমস্যায় পড়েন। তাঁরা মূলত মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল এবং এর পাশাপাশি অন্য কোনো ধরনের কাজের দক্ষতা না থাকায় তাঁদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দিনমজুরি করতে বাধ্য হন। অন্য এক-তৃতীয়াংশ কর্মহীন অবস্থায় কাটান।
সরেজমিন জেলে পল্লীগুলোতে ঘুরে জানা গেছে, উপজেলার আলীপুর ,মহিপুর, লালুয়া , কুয়াকাটা , ধুলাসার , ধানখালী, বাবলাতলার ঢোস , নিজামপুর, গঙ্গমতিজেলে পল্লি ঘুরে জেলেদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা তাদের দুর্দশার কথা জানান। উপকুলী এলাকায় ৪০টি জেলে পরিবারে ইলিশের ভরা মওসুমে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞায় জেলেদের মধ্য চরম হাহাকারের সৃষ্টি হয়েছে।
উপকূলীয় কুয়াকাটা ও আলীপুর মৎস্য বন্দরে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন এলাকার জেলেরা ট্রলার নিয়ে অবস্থা করছেন। ঈদের আগে সাগরে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞায় জেলেরা অসন্তুষ্ট । জেলেরা বলছেন, অক্টোবর মাসে ২২ দিন ইলিশ সংরক্ষণ, নভেম্বর থেকে জুন মাস পর্যন্ত ৮ মাস জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচি, মার্চ ও এপ্রিল এই দুই মাস জেলার বাউফল, দশমিনা, রাঙ্গাবালীর চর রুস্তম পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীর ১০০ কিলোমিটার ইলিশের অভয়ারণ্যে ইলিশ ধরা যায় না। এরপর ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জেলেদের বিপদে ফেলে দিয়েছে। এখন সাধারণ জেলেরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এই সময়ে সাগরের কোনো স্থানেই যান্ত্রিক এমনকি ডিঙি নৌকা দিয়েও মাছ আহরণ করা যাবে না।
সরকার ঘোষিত নিষিধাঞ্জা মেনে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন পর্যন্ত মা ইলিশ ধরা বন্ধ রেখেছে জেলেরা। অবসর সময়ে ছেঁড়া জাল তুনে ব্যস্ত সময় কাটছে। আলীপুর ,মহিপুর, লালুয়া , কুয়াকাটা , ধুলাসার , ধানখালী, বাবলাতলার ঢোস , নিজামপুর, গঙ্গমতিঘুরে দেখা যায় প্রায় সব ঘাটেই নৌকা সারিবদ্ধ ভাবে বেধেঁ রাখা হয়েছে উপকুলে। বোট ও ইঞ্চিন মেরামতের কাজ চলছে কোথাও কোথাও ।
জেলেদের অভিযোগ ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের জেলে তালিকায় অর্ন্তভুক্ত মৎস্য শিকারিদের (ভিজিএফ) খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করেছে সরকার। দীর্ঘ এ সময়ে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ জেলে পেশা পরিবর্তণ করে ভিন্ন পেশায় ঝুঁকেছেন। তবে তালিকা হালনাগাদ না হওয়ায় বর্তমানে সরকারের প্রদেয় এই সুবিধা থেকে ছিটকে পড়েছেন সত্যিকারের জেলেরা।
জেলেরা বলছেন, এমনিতেই করোনাকালে তাঁদের রোজগারে টান পড়েছে। তার ওপর সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় কীভাবে পরিবার চলবে, এ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে আছেন তাঁরা। নিষেধাজ্ঞা চলকালে জেলেরা খাদ্যসহায়তা হিসেবে চাল পান। তবে নিষেধাজ্ঞার সময় যে চাল দেওয়া হয়, তাতে এক মাসেরও খোড়াক হয় না। গরিব জেলেরা সাগরে নামতে না পারলে খাবেন কী? তাই বাধ্য হয়ে পেটের দায়ে অনেক জেলে জেল-জরিমানার ভয় উপেক্ষা করেন। তবে বেশির ভাগ জেলে ও ট্রলারমালিক আইন মেনে সাগরে যান না।’ যাঁরা পান, তাঁদের আবার ওজনে কম দেওয়া হয়। জেলে নন, এমন লোকেরাও চাল পান। জনপ্রতিনিধিসহ অনেকে জেলেদের চালে ভাগ বসান বলে অভিযোগ করেন এই জেলে।
এদের মধ্যে চলমান (ভিজিএফ) সুবিধাভোগী জেলেদের সংখ্যা রয়েছে ১০ হাজার ৫’শ ৯৩ জন। মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে প্রায় ৩৭ শতাংশ জেলে। শুধু জীবিকার তাগিদেই নয় প্রতি মূহুর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ শিকার করে অর্থনীতির চাকা সচল করছেন পেশাদার জেলেরা। উওাল সাগর ও বন্যার সময় জীবন যুদ্ধে হার না মানা এসব সাহসী আতনির্ভরশীল মানুষগুলো নির্ধারিত সময়ে কাঙ্খিত মৎস্য আহরনের লক্ষ্যে ছুটে যায় গভীর সমুদ্রসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে। এ সময় উওাল সাগরে ট্রলার ডুবে গেলে কারো কারো খোঁজ স্বজনেরা পেলেও অনেকেরই সলিল সমাধি হয়েছে সাগরে। আর এসব জেলেদের মৎস্য শিকারে নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে সরকারী ভাবে তালিকা প্রনয়নের মাধ্যমে বিশেষ প্রনোদনা (ভিজিএফ) এর আওতায় আনলেও হালনাগাদ তালিকার ফাঁদে পড়ে সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছেন পেশাদার জেলেরা।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা ৬৫ দিন দরকার আছে কি না, তা বৈজ্ঞানিকভাবে বিচার–বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত। কারণ, প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা ১৫ এপ্রিল থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত। দেশে এই সময়সীমা ১ মে থেকে ৩০ জুন করা হলে তা বেশি কার্যকর হতে পারে।
গঙ্গামতির জেলে আবুল হোসেন বলেন, ‘করোনায় মোগো মেরুদন্ড ভাইঙা ফেলছে। আবার পর ২২ দিনের ইলিশের অবরোধ (নিষেধাজ্ঞা), ৮ মাসের জাটকা ধরার অবরোধ। এখন গাঙ্গে-সাগরেও তেমন মাছ-পোনা নাই। এহন আবার ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা। ক্যামনে যে বউ-বাচ্চা লইয়্যা বাঁচমু, কইতে পারি না!’
চাড়িপাড়া গ্রামের জেলে জাফর বলেন, এই এলাকার ৯০ শতাংশ মানুষ মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। এখন তিন বেলা খাবার ঠিকমতো পরিবারের জোগাড় করতে কষ্ট হচ্ছে। ‘সাগরে ইলিশ শিকার বন্ধ। আমাদের আয়ের পথও বন্ধ রয়েছে। কিন্তু সাগরে মাছ শিকার বন্ধ থাকায় টাকা আয় করব কীভাবে আর কীভাবেই ছেলেমেয়েকে দু মোঠো ভাত লেখাপড়ার খরচ চালাবো তা জানি না।’
এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মাছের মোকাম হিসেবে পরিচিত মহিপুর মৎস্য বন্দরের মৎস্য আড়তদার সমবায় সমিতির সভাপতি মো. ফজলু গাজী বলেন ‘দক্ষিণের এ মৎস্য বন্দরে প্রায় লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। মৎস্য ভিত্তিক অর্থনীতি সুরক্ষায় জেলেদের পেশা পরিবর্তন রোধে খাদ্য সহায়তার পরিমাণ বৃদ্ধিসহ আর্থিক সহায়তা প্রদান এখন সময়ের দাবি।’
আলীপুর ট্রলার মালিক ও মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আনসার উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘শুরু থেকেই ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পুনর্র্নিধারণের দাবি জানিয়ে আসছেন ব্যবসায়ী ও জেলেরা। ভারতে এই নিষেধাজ্ঞা ৪৫ দিনের। শুরু হয় ১৫ এপ্রিল থেকে। তাই ভারতের সঙ্গে মিল রেখে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা নির্ধারণ করা হলে তা বেশি কার্যকর হবে।’
বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক মো. কামরুল ইসলাম বলেন, শুধু ইলিশ নয়। বঙ্গোপসাগরে ৪৩৫ প্রজাতির গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য সম্পদ রয়েছে, যা সংরক্ষণ ও নিষ্কণ্টক প্রজননের স্বার্থে এবং সমুদ্রনির্ভরশীল অর্থনীতির লাগসই উৎপাদন ও বাস্তবায়নের নিমিত্তে সরকার বঙ্গোপসাগরের জলসীমায় নিরঙ্কুশ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৬৫ দিনের জন্য সব ধরনের মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ করেছে।